১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এর সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সদনের মঞ্চ অপরবিহারিত এক অলৌকিক বৈষ্ণব নাট্যভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ নৃত্য অ্যাকাডেমি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের সহযোগিতায় আয়োজিত শাস্ত্রীয় নৃত্য উৎসবে, ‘আনন্দ চন্দ্রিকা’ নৃত্যদল মহাকবি জয়দেবের ‘অষ্টপদী’ অবলম্বনে ‘দশ অবতার’ শিরোনামে এক মনোমুগ্ধকর ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবেশনা উত্থাপন করল।
এই পরিবেশনাটি শুরু হয় প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও গুরু অধ্যাপিকা অমিতা দত্তের সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে। তিনি প্রতিটি অবতারের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে দর্শকদের মনে মহান গাথার বীজ বপনের জন্য প্রস্তুত করেন। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় একটি নৃত্য-ভাষ্য, যেখানে ঈশ্বরের অবতাররূপগুলি মঞ্চে একটির পর একটি আবির্ভূত হতে থাকে।

প্রথমেই দেখা যায় বিষ্ণুর ধরণীতে অবতরণের উদ্দেশ্য, যেগুলি হলো, অধর্মের বিনাশ, ধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং ভক্তদের রক্ষা। এই উপলব্দিটি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে আলাপ ও বিমূর্ত নৃত্যের মাধ্যমে।
এরপর একে একে উপস্থিত হয় দশটি অবতার। প্রলয়ের মাঝে জলমগ্ন পৃথিবীতে দেখা দেয় বিষ্ণুর মৎসাবতার। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং আলোর ঝলকের মাঝে সেই রূপ দৃঢ়তা ও আবেগে ভরা। কূর্ম অবতারে তুলে ধরা হয় মন্থনকথার কাহিনী—দেব-দানবদের সংঘর্ষ এবং মন্দর পর্বতের বোঝা নিয়ে ঈশ্বরের কচ্ছপ রূপ ধারণ। বরাহ অবতারে বিশাল শূকরের রূপ ধারণ করেন, যিনি দানব হিরণ্যাক্ষের হাত থেকে ধরিত্রীকে রক্ষা করেন। নরসিংহ অবতার মঞ্চে প্রবেশ করেন গর্জনের সাথে, স্তম্ভ বিদীর্ণ করে আবির্ভাব ঘটে।
এরপর ঈশ্বর বামন অবতারে এক নিষ্পাপ শিশুর রূপে উপস্থিত হন, এবং পরবর্তী মুহূর্তেই বিশাল আকার ধারণ করে মহাবলিকে পরাস্ত করেন। এখানেই একটি নতুনত্ব দেখা যায়; দক্ষিণ ভারতের বালিকে কেন্দ্র করে এই অংশে কর্ণাটকি তাল এবং ছন্দের অনবদ্য প্রয়োগ সত্যিই অভিনব ছিল।
পরশুরাম অবতারে উগ্র শক্তির এক নতুন রূপ অভিব্যক্তি পায়—তাঁর ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা এবং তীক্ষ্ণ অস্ত্রের আক্রমণে যেন আসমান তছনছ হয়ে যায়। রাম ও রাবণের যুদ্ধকে এক শাস্ত্রীয় নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়, যেখানে প্রতিটি ভঙ্গি যুদ্ধের ঘটনাবলীর বর্ণনা করে। বলরাম অবতারে কৃষি সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট হয়, যিনি তাঁর হালের মাধ্যমে নদীর সৃষ্টি করেন এবং মাটির গভীর সংযোগ অনুভব করেন—সকল কিছুই চরম নিস্তব্ধতা ও গভীর আবেগে ভরা।
বুদ্ধ অবতার নিঃশব্দ বিপ্লবের সূচনা করেন—এটা হিংসার পরিবর্তে ধ্যান এবং দয়ার মাধ্যামে ঘটে। আবেগের অভাব, ঔদাসীন্য এবং শান্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের অন্য একটি রূপ প্রকাশ পায়। সবশেষে, কল্কি অবতার ঘোড়ায় চড়ে এসে অগ্নিময় মেঘের মতো দ্রুত গতিতে ছুটে আসে, যেন অন্ধকার যুগের সমাপ্তি ঘটানোর উদ্দেশ্যে। দর্শকরা তা দেখে প্রশান্তি ও বিস্ময়ে থমকে যায়।
অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তে জয়দেবের স্তব পাঠ এবং প্রার্থনা অনুষ্ঠানটিকে এক অসম্পূর্ণ পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়। এমন মনে হয়, দশটি অবতার নয়, বরং দশটি দর্শনের প্রতীক হয়ে উঠেছে—মানবজাতির বিবর্তন, বিশ্বাস এবং মুক্তির এক অবিরাম যাত্রা।
নৃত্য পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেছেন অমিতা দত্ত, শ্রামণা চট্টোপাধ্যায়, পম্পা পাল, পম্পা রায়, শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী, বিদিশা জানা ও মঞ্জিমা রায়। প্রতিটি শিল্পীর কোরিওগ্রাফি, ভঙ্গিমা, অভিব্যক্তি ও তালজ্ঞান ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম, তাদের কঠোর পরিশ্রমের প্রমাণ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
এই পরিবেশনা কেবল একটি নৃত্য প্রদর্শনী নয়, বরং এটি ছিল একটি নান্দনিক ও আধ্যাত্মিক যাত্রা। আয়োজক এবং শিল্পীরা মিলে একটি শিল্পসন্ধ্যা তৈরি করেছেন, যা দর্শকদের হৃদয়ে দীর্ঘদিনের জন্য গেঁথে থাকবে।