একটি খালি সসের বোতলের মধ্যে ছোট্ট একটি নৌকায় অবস্থান করছেন মা দুর্গা এবং তাঁর চার সন্তান—লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশও সঙ্গে রয়েছেন। প্রথম দৃষ্টিতে এই দৃশ্যটিকে বিশ্বাস করা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু বাঁকুড়ার শিল্পী ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়ের কৌশলগত দক্ষতার মাধ্যমে এই অসম্ভবকে বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব হয়েছে।
পেশায় যদিও তিনি অঙ্কন শিক্ষক, ইন্দ্রনীলের প্রকৃত পরিচয় তাঁর চমৎকার শিল্প নির্মাণের দক্ষতা। বাঁকুড়ার জুনবেদিয়ার এই শিল্পী দুর্গাপুজোর সময়ে বছরের পর বছর বিস্ময়কর শিল্পকর্ম উপহার দিয়ে আসছেন, যার প্রতিটি কাজ একেকটি অনন্য সৃষ্টি।
তিনি আগেই চাল, ধান, গম, এলাচ, ছোলা, এমনকি আখরোটের খোলার মতো ছোট ছোট উপাদান দিয়ে দুর্গার প্রতিমা তৈরি করেছেন। তবে এবারের সৃষ্টি সত্যিই এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একটি সাধারণ কাঁচের বোতলের ভেতরে তিনি মা দুর্গার সম্পূর্ণ পরিবার ও সঙ্গী দেব-দেবীগণের বাহনগুলো অনবদ্যভাবে গড়ে তুলেছেন। শিল্পের জটিলতা এতটাই উজ্জ্বল যে, বোতলের বাইরের দিক থেকে দর্শকদের জন্য এটি সত্যিই অভূতপূর্ব।
এই কাজটির অন্যতম আকর্ষণ হলো, এটি সম্পূর্ণভাবে হাতে তৈরি। বোতলের মধ্যে বাইরের কোনো উপাদান যোগ করা হয়নি; বরং বোতলের সরু মুখের মাধ্যমে একটানা প্রবেশ করিয়ে ভিতরে ধাপে ধাপে প্রতিটি অবয়ব নির্মাণ করা হয়েছে। কাঁচ, তার ও মাটি এই শিল্পকর্মকে সৃষ্টি করতে দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রমের ফলস্বরূপ।
এলাকায় এই শিল্পের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল জেগে উঠেছে। উৎসুক দর্শকদের ভিড় শিল্পকর্মটি উপভোগ করতে এসেছে। কেউ মোবাইলে ছবি ধারণ করছে, কেউ আবার বিস্ময়ে বোতলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এত সূক্ষ্ম একটি কাজ কিভাবে সম্ভব!
তবে, এই বোতলের দুর্গা ইন্দ্রনীলের জন্য নতুন কোনো বিস্ময় নয়। এর আগে তিনি একটি দেড় সেন্টিমিটার লম্বা কাচের বোতলে যিশুর জন্মের দৃশ্য নির্মাণ করে সকলকে অবাক করেছেন। এছাড়া, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প ইউনিসেফ পুরস্কার পাওয়ার মুহূর্তটিও তিনি তাঁর শিল্পের মাধ্যমে বোতলের অভ্যন্তরে তুলে ধরেছেন।
শুধু বোতল নয়, তিনি শোলা দিয়ে দুর্গা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি এবং বৈদ্যুতিক বাল্বের ভেতরে সান্তাক্লজের সৃষ্টি করেছেন—এসব সবই তাঁর শিল্পের পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত। তাঁর এই অসাধারণ সব কাজের জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন।
তাঁর কোনো অফিসিয়াল প্রশিক্ষণ নেই এবং বড় কোনো শিল্পবিদ্যালয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও নেই। আত্মবিশ্বাস, প্রচণ্ড ধৈর্য এবং সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে তিনি নিজের একটি অনন্য পথ তৈরি করেছেন।
ইন্দ্রনীলের মতো শিল্পীরা দেখাচ্ছেন, শিল্প কেবল রং এবং তুলি নয়, বরং নিজের চিন্তাভাবনাকে এক নতুন রূপ দেওয়া। যেখানে সীমাবদ্ধ বস্তুগুলোও অসীম কল্পনার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। বোতলের ভেতরে মা দুর্গার এই প্রাকৃতিক রূপ তারই একটি উদাহরণ।