সুতো, মাটি আর স্বপ্ন: শহুরে নারীদের সৃজনশীল জীবিকা সংগ্রাম

শহরের যন্ত্রণা ও ব্যস্ত জীবনে, কর্মস্থল, গৃহ এবং পরিবারের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে অনেক নারী প্রত্যহ এক অদৃশ্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই ব্যস্ততার মাঝে, তাঁরা নিজেদের সৃজনশীলতা বজায় রাখার নানা উপায় খুঁজে বের করছেন। এই অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ঘটেছে শহুরে ভারতের এক নতুন অধ্যায়ে—যেখানে সূচের কাজ, মাটির পুতুল তৈরি, এবং ক্রোশের নকশা একসাথে মিলিত হয়ে জীবিকার ও আত্মসম্মানের একটি নতুন কাহিনী তৈরি করছে।
দীনদয়াল উপাধ্যায় অ্যান্ট্যোদয় যোজনা এবং ন্যাশনাল আরবান লাইভলিহুডস মিশন (DAY-NULM) যথেষ্ট সময় ধরে শহুরে দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য কাজ করে আসছে। এই প্রকল্পের সাহায্যে অনেক মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী (SHG) নানা ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেছেন, যেমন ক্যান্ডেল তৈরি, মিলেট কুকি, গয়না, ব্যাগ এবং হাতে তৈরি অন্যান্য সামগ্রী—এগুলো সবই তাঁদের স্বনির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোভিড-১৯ লকডাউনের সময় ‘উম্মিদ কি রাখি’ এবং ‘উম্মিদ কি রসোই’ এর মতো বিভিন্ন উদ্যোগ শহুরে বাজারে নারী গোষ্ঠীগুলিকে সম্পৃক্ত করেছে।
এই প্রেক্ষিতেই উঠে এসেছে ‘দ্য সানফ্লাওয়ার লেডিস’। দক্ষিণ দিল্লির মায়া ও কৌশল্যা, দুজনেই গৃহকর্মী, দিনের কাজ শেষে রাতে সূর্যমুখীর নকশা ক্রোশে করে ব্যাগে তুলছেন। তাঁদের তৈরি ব্যাগ, প্ল্যান্টার, এমনকি ভ্যান গঘ অনুপ্রাণিত হেডব্যান্ড আজ ইনস্টাগ্রামে জনপ্রিয় পণ্য। কিন্তু এর চেয়েও বড় বিষয়, এই উদ্যোগ তাঁদের দিয়েছে নতুন পরিচয় ও আত্মবিশ্বাস। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা বিবেক বৈদ জানিয়েছেন, “প্রত্যেক সেই নারীকে সম্মান জানাতেই এই উদ্যোগ, যিনি সন্তানের শিক্ষার জন্য লড়ে চলেছেন।” আজ এই প্রকল্প ছড়িয়েছে কোহিমা, দিমাপুর, পাটিয়ালা, আহমেদনগর, সুরাট ও জয়পুরে।
মুম্বইয়ে শুরু হয়েছে আরেক সৃজনশীল উদ্যোগ—বানাগলু। টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুকন্যা উপাধ্যায় ২০২৩ সালে কান্দিভলির নিজের বাড়িতে ছোট জমায়েত দিয়ে শুরু করেন এই প্রয়াস। এখানে গৃহকর্মীরা সন্ধ্যায় একত্র হয়ে মাটি ও ইপক্সি দিয়ে তৈরি করেন নানা শিল্পকর্ম। সাভিতা, যিনি ১২ ঘণ্টা কাজ করেন, তৈরি করেন “পিঙ্কু দ্য ক্যাটারপিলার” নামে এক মাটির পুতুল, যা বিক্রি হয়ে যায় মুহূর্তে। অন্যদিকে প্রিয়া রঙিন লঙ্কা ও ফলের মডেল বানান।
এই জায়গাগুলো শুধু অর্থনৈতিক সুযোগই নয়, নারীদের জন্য হয়ে উঠেছে বিনোদন ও মুক্তির পরিসর। হাসি, আলাপ, আর সৃজনশীলতার মিলনস্থল। বানাগলু ইতিমধ্যেই আশ্রয়গৃহের বাসিন্দা, ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তি ও অন্যান্য নারী গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। সুকন্যার কথায়, “আমাদের লক্ষ্য এমন এক জায়গা তৈরি করা, যেখানে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষরা আনন্দের সঙ্গে নিজেরা কিছু তৈরি করতে পারবেন, নিজেদের প্রকাশ করতে পারবেন, এবং নিজের পরিশ্রমে উপার্জন করতে পারবেন।”
পূর্ব দিল্লির নির্মাণ বিহারে রানির মতো মেয়েরা তিজ বা জন্মাষ্টমীতে মেহেন্দির কাজ করেন, আর লক্ষ্মী ভোরে উঠে ইডলি-দোসার ব্যাটার তৈরি করে অফিসের পথে বেরিয়ে যান। কেউ গয়না বানান, কেউ ফুল বিক্রি করেন—সবাই নিজেদের মতো করে এগিয়ে চলেছেন।
এইসব ছোট গল্পগুলো একসঙ্গে মিলে বলে দেয়—শহুরে নারীরা শুধু সংসার টিকিয়ে রাখছেন না, তাঁরা তৈরি করছেন সৃজনশীলতার নতুন অর্থনীতি। তাঁদের প্রয়োজন শুধু আরও একটু সহায়তা—সরকার, কর্পোরেট দায়বদ্ধতা ও সমাজের পক্ষ থেকে—যাতে এই অদৃশ্য প্রতিভারা আলোয় আসে, আর শিল্প ও জীবিকা একসঙ্গে এগিয়ে চলে।
এই ছোট গল্পগুলো একত্রিত হয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করে—শহরের নারীরা শুধু পরিবারের তত্ত্বাবধান করছেন না, বরং তাঁরা একটি নতুন সৃজনশীল অর্থনীতির জন্ম দিচ্ছেন। তাঁদের সার্বিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন কিছু অতিরিক্ত সহায়তা—সরকার, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের পক্ষ থেকে—যাতে এই অনুপম প্রতিভাগুলি বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বল হয় এবং শিল্প ও জীবিকা পাশাপাশি সুসংগতভাবে এগিয়ে যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *