অসমের সাংস্কৃতিক দুনিয়ায় এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো, যখন সুপ্রতিষ্ঠিত বাঁশরী শিল্পী দীপক শর্মা ৫৭ বছর বয়সে ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুতর যকৃত রোগে ভুগছিলেন এবং চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
দীপক শর্মার মৃত্যু, অসমের সঙ্গীত জগতের জন্য এক বিশাল ক্ষতি বলে বিবেচিত হচ্ছে। আর এই পরিস্থিতিতে, যখন অসম এখনও তার প্রখ্যাত গায়ক জুবিন গার্গের অকাল মৃত্যু থেকে সেরে ওঠেনি, তখন দীপক শর্মার চলে যাওয়া সবাইকেই দুঃখের আবর্তে ডুবিয়ে দিয়েছে। সংগীত প্রেমিকদের পাশাপাশি, অসমের প্রতিটি নাগরিক তার মৃত্যুতে শোকাহত।
দীপক শর্মার জন্ম অসমের নলবাড়ি জেলা, পানিগাঁওয়ে। তাঁর ছোটবেলা থেকেই বাঁশির প্রতি এক বিশেষ আকৃষ্টতা ছিল। সংগীতের জগতে তাঁর যাত্রা হয়েছিল নানা কষ্টের মধ্য দিয়ে। তবে, কঠোর পরিশ্রম, প্রতিভা ও নিষ্ঠার ফলে তিনি শুধুমাত্র অসমেই নয়, বরং সারা দেশে এক অসাধারণ বাঁশি শিল্পী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার শিষ্য হিসেবে তিনি সঙ্গীতের মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।

দীপক শর্মা ছিলেন একজন প্রকৃত শিল্পী, যার বাঁশির সুরে অসমের প্রাকৃতিক রূপ ও ঐতিহ্য সঞ্চারিত হতো। তাঁর বাঁশির সুর যেন অসমের নদী, হ্রদ, বন ও লোকগাথার কাহিনীগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলতো। অসমের মানুষের হৃদয়ে তিনি ছিলেন এক সুরের জাদুকর, যিনি তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীর সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন।
তিনি দীর্ঘকাল ধরে একটি গুরুতর যকৃতের রোগে ভুগছিলেন এবং কিছু মাস ধরে তাঁর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিপদের দিকে যেতে থাকে। প্রথমে তাঁকে গুয়াহাটি শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে চেন্নাইয়ের একটি বিশেষজ্ঞ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, তিনি জীবনযুদ্ধে পরাজিত হন।
এছাড়াও, তাঁর চিকিৎসার খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তিনি আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হন। তবে অসম সরকারের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অক্টোবর মাসে উল্লেখযোগ্য সহায়তা প্রদান করেছিলেন, যা কিছুটা হলেও তাঁর পরিবারে আর্থিক চাপ কমানোর চেষ্টা ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি এবং চিকিৎসার ব্যয়ের কারণে তিনি বাঁচতে পারেননি।
দীপক শর্মার জীবনের শেষ কয়েকটি দিন ছিল অত্যন্ত কঠিন সংগ্রাম। অসুস্থ অবস্থাতেও, তিনি শেষ সময়ের কিছুটা অংশ মিউজিকের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা রাখতে সমর্থ হন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অবস্থায়, তিনি তাঁর শেষ বাঁশির সুর বাজিয়েছিলেন, যা তাঁর অনুগামীদের হৃদয়ে চিরকালীন স্মৃতি হয়ে থাকবে।
৪ নভেম্বর, ২০২৫ তারিখে গুয়াহাটি শহরে দীপক শর্মার মরদেহ এসে পৌঁছানোর পর হাজার হাজার মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হন। প্রথমে তাঁর মরদেহ তাঁর জন্মস্থান আম্বিকাগিরি নগরে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে সেউজ সংঘে রাখা হয়। সেখানে তাঁর পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং অসংখ্য শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি তাঁকে গভীর সমর্থন ও সম্মান জানান।
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং তাদের সমর্থকরা তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে বাঁশি বাজিয়ে শোক প্রকাশ করেন। এ মুহূর্তে অসমের জনগণ যেন অনুভব করছিল, তাঁর বাঁশির মিষ্টি সুরে হারিয়ে গেছে একটি যুগের গল্প—একটি সুর, যা অসমের মানুষকে বিশ্ব পদচারণায় তুলে ধরেছিল।
দীপক শর্মা কেবল একজন শিল্পীই ছিলেন না, বরং তিনি অসমের সংস্কৃতির এক অমূল্য গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর বাঁশির সুরে ছিল অসমের ঐতিহ্য, রূপ, এবং জনগণের গভীর অনুভূতি। তাঁর মৃত্যুতে অসম এবং ভারতীয় সঙ্গীত জগতে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, যা পূরণের চেষ্টায় কঠিন হবে। তবে, তাঁর সৃষ্টিগুলি, তাঁর সুরগুলি চিরকাল আমাদের মধ্যে বিরাজ করবে, এবং তিনি আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য এক শক্তিশালী অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
অসমের শোকের মুহূর্তেও, দীপক শর্মা তাঁর অমর সঙ্গীতের মাধ্যমে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।