শান্ত ধারায় প্রবাহিত হওয়া শত শত তটিনী বেষ্টিত জনপদের গল্পে, জনপদের মানবকূল মায়ারতরী বাইতে যায়। কতটা জীবন ঘনিষ্ঠ না হলে, কতটা জীবনের অংশ না হলে বাউলের বাদ্যযন্ত্রের সুরে ও কথায় পরিণতি পায়।
দেহ-তরী দিলাম ছাড়ি, ও গুরু তোমার নামে
নদী বিধৌত জনপদ এই বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল আমাদের বাংলাদেশ। বরফগলা স্রোতধারাই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত জলরাশিতে পরিণত হয়ে নদী, খাল-বিলের সৃষ্টি করে। সাগর তা’ অবশেষে আলিঙ্গন করে পরম মমতাই। এই জলরাশির বয়ে আনা মৃত্তিকার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে জনজীবনের গল্প। আচ্ছা, জীবন যদি নদীকেন্দ্রিক হয়; তবে তো জলরাশি, মাটি জীবনের পাথেয় হওয়া উচিৎ কিন্তু মানবকূল কতটা তা অনুধাবন করতে পারে? বাংলার জনপদে নদী আর্শীবাদ, আর মাটি এখানে মা। মাটি শুধু খাদ্যসংস্থান করেছে তা নয়, আশ্রয়ের খুঁটিও। একটিও আগ্নেয়গিরি নেই এই মৃত্তিকা অংশে, আছে মাতৃগর্ভের চরম নিরাপত্তা বেষ্টিত জীবনের নিশ্চয়তা।
কিন্তু মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে নানা কার্যক্রমের ভিতর দিয়ে। খুবই সুক্ষ্মভাবে এই মাকে কষ্টে ফেলেছে এই সন্তানেরা।
ঠিক এই কষ্টকে অনুধাবন করেতে পেরে সন্তানের বিবেকের সামনে শিল্পের ভাষা নিয়ে দাঁড়িয়েছে “বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশন”। বৃহত্ত্ব মাতৃকা বন্দনা প্রথম থেকেই করে আসছে। বৃহত্ত্ব বিশ্বাস করে মা, মাটি আলাদা নয়। প্রকৃতির উপর নির্ভর করে মানুষ আছে, মানুষের উপর নির্ভর করে প্রকৃতি নয়। জনপদে যে বাতাস প্রবাহিত হয়ে থাকে তা আর্শীবাদ, তাকে লালন করা দরকার। গঙ্গা বুড়ি শিরোনামে ধারাবাহিক ভাবে উপস্থাপন করতে লাগলো নদীতীরের গড়ে উঠা মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ সবই তা’ শিল্পের ভাষায়। স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য স্বার্থপরের মতন শুধু জল, বায়ু, মাটিকে মানুষ ব্যবহার করেছে, ফেরত দিয়েছে শুধুমাত্র অবহেলা। “বৃহত্ত্ব আর্ট পরিবার” বিভিন্ন শিল্পীর প্রকাশ মাধ্যমকে বেছে নিয়ে মানুষের বিবেককে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টায় রত তা’ প্রদর্শনী বলে দেয়।
প্রাণ-প্রকৃতির বিবেকসম্পন্ন একজন মানুষ হয়ে উঠে বাউল, তার অনুধাবনে আসে বাইতে জান না কেন হাল ধরো। আসলেই জানিনা কিভাবে প্রকৃতির হাল ধরে রাখতে হবে। ” পাল: ভূমি, জল, পবন” প্রদর্শনী ধারাবাহিক প্রদর্শনীর অংশ এবং যা কিনা শান্তভাবে নাড়া দিচ্ছে আমাদের বিবেক। প্রদর্শনীর বিন্যাস খুবই ধীর, শান্ত আবেশ দেয়। কোন জটিলতা নেই যেমনটি আসলে প্রকৃতির স্বভাব। নৌকার পাটাতনের উপর খালি পা স্পর্শ করলে যেন কুল-কুল স্রোতধারা তালু স্পর্শ করে। নাও পবনের ধারা পুরো প্রদর্শনী কক্ষে। তাপানুকূল পরিবেশ থেকে আসা দর্শনার্থীরা যেন শেকড়ের কাছাকাছি তা’ তাদের ধীর-স্থিরতা বলে দেয়। পাটের গন্ধ ও মাছের জালের আলো-ছায়া একটা নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে, এখানে যা প্রকৃতির মতন। শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী প্রকৃতির বিবেককে শিল্পের ভাষায় প্রকাশ করছেন দারুণ বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে। প্রকৃতি জৌলুসপূর্ন নয়, তা সাধারণ, ধীর, স্বাভাবিক; পক্ষান্তরে, মানুষের জীবনব্যবস্থা জটিল, অতিরঞ্জনকৃত। কিন্তু পালের পবন যেন জল ও ভূমিকে স্পর্শ করতে পারে, তারই চেষ্টায় রত বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশন।
বুঝিয়ে বলো তারে যেতে হবে পারে হালটি ছাড়িয়া এখন দাও… দাও রে…
সবকিছুর পরও এই মানবকূল অবুঝের আরেক উদাহরণ- বুঝিয়ে বলতে হয় সবটা। বৃহত্ত্ব আর্ট পরিবার হাল ছাড়বার নয়, শিল্পের ভাষায় যেতে হবে দূরে- অনেকটা দূরে। তা’ বুঝতে পেরে বারংবার আয়োজন করে মা-মাটির উপলব্ধিগত প্রদর্শনী। শিল্পের বাউল বৃহত্ত্ব, চলুক বহিমিয়ান যাত্রা, যাত্রী হোক অগ্রগতি শিল্প-সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ, সেই যাত্রায়।