কাজল সেনগুপ্ত স্মরণে
জয়ন্ত কুণ্ডু
সর্বভারতীয় সংগীত ও সংস্কৃতি পরিষদ
কাজলবাবু সম্পাদক তার করেছেন মেহানত।
শিক্ষাকতা পেশা হলেও, সংগীতে অনুরাগ,
‘পরিষদ’ গড়তে গিয়ে করেছেন প্রাণপাত।
ভীযণ ভদ্র, পরিচ্ছন্ন, অমায়িক ব্যবহার,
বিচক্ষণ আর বিবেচনায় তার মত নেই আর।
বত্রিশ বছর পরিষদে, তাকে নিয়ে কত স্মৃতি,
পেয়েছি আমি তার কাছ থেকে, ভালোবাসা আর প্রীতি।
হস্তাক্ষর আর লেখনির গুণে, ছিলাম আমি প্রিয়,
ভরসা ছিল আমার প্রতি, আমার পূজনীয়।
ছেচল্লিশের সমাবর্তন, তার সাথে শেষ দেখা,
খুশি মনেই দেখেছিলেন, আমার কবিতা লেখা।
পরামর্শ দিতেন আমায় সাথে অনেক ভরসা,
বুঝিনাতো চলে যাবেন, এমন করে সহসা….।
সর্বভারতীয়র আর কাজলবাবু দুয়ে মিলে একাকার,
অসংকোচে বলতে পারি, আপনি অহংকার।।
কাজল সেনগুপ্ত
“কে বলে যাও-যাও, তোমার যাওয়া তো নয় যাওয়া”
জয়ন্ত কুণ্ডু
কাজল সেনগুপ্ত, সর্বভারতীয় সঙ্গীত ও সংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক ছিলেন। পেশায় শিক্ষক, হলেও মননে ও চিন্তনে আদ্যোপান্ত ছিলেন একজন সঙ্গীত শিল্পী। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। কাজলবাবুর মত অমন সুপুরুষ বড় একটা চোখে পড়ে না আমার। বাঙালার হৃদয় যেমন নায়ক উত্তমকুমার, যার হাসি, কথা বলার ধরন, হাঁটা চলার ভঙ্গিমা, অভিনয় ক্ষমতা যা একেবারে চরিত্রের সাথে মিশে যেতেন, যা এখনো আমাদের মুগ্ধ করে, তেমনি আমাদের ‘সর্বভারতীয়’ পরিবারে, কাজলবাবু ছিলেন নায়ক উত্তমকুমারের মতনই। ধুতি-পাঞ্জাবী বা পায়জামা পাঞ্জাবীতে চমৎকার মানাতো তাকে। ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা, অতলান্ত সুন্দর চোখ, সুন্দর বাচনভঙ্গি, মানুষ চেনার অসাধারণ ক্ষমতা, আর ‘চরৈবোত’ মন্ত্রে দিক্ষিত। থেমে থাকা পছন্দ করতেন না।
আমি সর্বভারতীয়র সদস্য হয়েছিলাম আজ থেকে বছর ৩৫ আগে। এখন আমার ষাট পার হয়েছে, সেই হিসাবে তখন ছিলাম ২৫-২৬ বছরের তরুণ। গুঁটিকয়েক ছাত্র ছাত্রীকে আঁকা শেখাতাম। আমার পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী স্নেহময় আইচ সর্বভারতীয় থেকে অ্যাফিলিয়েশন নিয়েছিলেন, তার কাছে থেকে খবরা খবর নিয়ে পরিষদ অফিসে এসেছিলাম। মুখোমুখি হয়েছিলাম পঙ্কজ সাহার। আমায় পাশে বসিয়ে অনেক কথা বললেন-শুনলেন। সদস্য হলাম। ঐ সময় দোতলা বাড়ীর নীচের তলায় অফিস, ওটার তলায় উনি থাকতেন। সম্পাদক কাজল বাবুর সাথে পরিচয় ঘনিষ্ঠতা এর পরে হয়েছিল।
সেইসময় আজকের মত কেন্দ্র ছিলনা। তাই কেন্দ্র ব্যবস্থাপকদের অনেককেই নামে চিনতেন। আমাকে খুবই ভালোবাসতেন আবার একটু প্রশ্রয়ও দিতেন কারণ আমার লেখন শৈলী , হাতের লেখা ও মার্জিত রুচির কারণে। সেই সাথে সবার সাথে মিলেমিশে চলার ক্ষমতার কারণে। এই একই কারণে প্রয়াত গদাধর বাবু, শিবনাথদা, গুপ্তবাবু আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। কাজলবাবুর নিরদেশ ছিল, যে সব কেন্দ্র অ্যাফিলিয়েশন নিয়ে নতুন করে পরীক্ষার সূচনা করছে, সেখানে যেন আমাকে পাঠানো হয় যাতে করে আমি পরীক্ষক হিসেবে গিয়ে সেখানে কেন্দ্র ব্যবস্থাকে
হাতে কলমে কাজটা বুঝিয়ে দিয়ে আসতে পারি। একদিন আমার সামনে কাজলবাবু, শিবনাথদাকে বলেছিলেন, আমি পরীক্ষক জয়ন্তর সুনাম সবার কাছ থেকে পাই, এই রকম পরীক্ষকই পরিষদের অহংকার, পরিষদের মুখ উজ্জ্বল করবে।
কাজলবাবু ভালো সংগঠক ছিলেন, সেই সাথে অসাধারণ কর্মী। সম্পাদক হিসেবে পরিষদকে উন্নতির চরম শিখরে তুলেছিলেন। কত মামলা করে তার সংস্কৃতি ভবন নির্মাণ। আজ পরিষদে কত কর্মী, যারা এখানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। পরিষদের চেহারাটাই বদলে দিয়েছেন তিনি। আজ সর্বভারতীয়র শাখা রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায়, এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে। আমি যেখানে থাকি সেই রহড়া ও খড়দহে এর প্রায় ৩০টি কেন্দ্র রয়েছে। তারা সুন্দরভাবে তাদের কেন্দ্র পরিচালনা করছে, আর সবার সাথে সবার সম্পর্ক অত্যন্ত প্রীতির।
২০২৪ সালে মহাজাতি সদনে কনভেকোশনে আমার সাথে ওনার শেষ দেখা হয়েছিল। ঐ বছর আমাকে পরিষদের পক্ষ থেকে জীবনকৃতি সম্মানে সম্মানিত করা হয়, কাজলবাবুর উপস্থিতিতে আমার হাতে মানপত্র তুলে দিয়েছিলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়। ঐ দিন কাজলবাবুর পাশে বসে অনেক কথা হল, শরীর নিয়ে প্রশ্ন করাতে বলেছিলেন, “এইতো ডায়ালিসিস নিয়ে ফিরেছি, দিন আমার শেষের পথে। শান্তনু আছে ওর পাশে থেকো, পরিষদকে এগিয়ে নিয়ে যেও।” আমি কথা দিলাম। ঐদিন অনুষ্ঠান ও আমার সম্মান প্রাপ্তি নিয়ে লেখা আমার কবিতা-ছবি দেখালাম। বললেন পড়ে শোনাও। পড়া শেষ হলে নির্মল হাসি খেলে গেল মুখে। কাজলবাবুকে নিয়ে এমনি কত স্মৃতি মনের মনিকোঠায়, যা বিবর্ণ হবার নয়। তিনি যে দায়িত্ব আমায় অপর্ণ করে গেছেন, শুধু বলবো আমায় শক্তি দিন, আমি যেন তা বয়ে নিয়ে যেতে পারি।।

লেখক
জয়ন্ত কুণ্ডু
