কলকাতার বিরিয়ানির প্লেটে আলু না থাকলে কি আদৌ সেটা বিরিয়ানি হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হয় ইতিহাসের পাতায়, নবাবদের শৌখিনতায়, কলকাতার বাবু সংস্কৃতিতে এবং বাঙালির ভোজনরসিক ঐতিহ্যের গভীরে। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ — লখনৌয়ের শেষ নবাব, যিনি ব্রিটিশদের হাতে রাজ্য হারিয়ে চলে এসেছিলেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে। কিন্তু শুধু রাজ্য নয়, নবাব সঙ্গে এনেছিলেন এক অমোঘ সংস্কৃতি, আনলেন লখনৌয়ের নবাবি রান্নাঘরের সুগন্ধ।
অনেকেই বলেন, কলকাতার বিরিয়ানিতে আলু ঢুকেছে নবাবের দারিদ্র্যের কারণে। পেনশনের টাকায় নাকি বিরিয়ানি চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল বলে মাংসের পরিমাণ কমিয়ে আলু ঢোকানো হয়েছিল। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নবাবের বংশধররা এই গল্পকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন। তাদের দাবি, নবাবের হাতে প্রচুর সম্পদ ছিল। তার হাতে ছিল হাতিশালা, ঘোড়াশালা, এমনকি নিজের চিড়িয়াখানা, যেখানে প্রতিদিন বাঘ-সিংহের জন্য কিনা কিলো কিলো মাংস কেনা হত। যিনি পশুদের জন্য এতটা বিলাসিতা করতেন, তিনি নিজের প্লেটের জন্য কেন কার্পণ্য করতেন?
তবে আলু বিরিয়ানির গল্প এখানেই থেমে যায় না। অনেক গবেষক বলেন, এই আলুর আমদানি হয়েছিল কলকাতার বাবুদের দুর্বল পেটের কারণে। নবাবি মশলাদার খাবার হজম করতে হিমশিম খাওয়া কলকাতার বাবুরা নাকি আলুর মাধ্যমে সেই খাবারকে সহজপাচ্য করতে চেয়েছিলেন। আবার কেউ বলেন, স্বাধীনতার পরে যখন কলকাতার মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে বিরিয়ানি পৌঁছাতে শুরু করে, তখন মাংসের পরিমাণ কমিয়ে খরচ বাঁচাতে আলু ঢুকে পড়ে বিরিয়ানির পাত্রীতে।
আবার কেউ কেউ ইতিহাস ঘেঁটে দেখান, আলু ভারতবর্ষে এসেছিল অনেক আগেই, পর্তুগিজদের হাত ধরে। বাংলার সাধারণ মানুষের পাতে ঢুকতে সময় লেগেছিল আরও। নবাবের সঙ্গে কলকাতায় আসা বাবুর্চিরা যখন কলকাতার বাজারে নতুন এই সবজির সন্ধান পেলেন, তখন তারা মাংসের সঙ্গে রান্না করে দিলেন এক অপূর্ব স্বাদের বিরিয়ানি। সেই নতুনত্বেই মজেছিল নবাবের জিভ। সেই স্বাদ রয়ে গেল কলকাতার রান্নাঘরে চিরস্থায়ী হয়ে।
কিন্তু মজার বিষয় হল, আজও লখনৌ, হায়দরাবাদ, দিল্লি, কিংবা পাকিস্তানের বিরিয়ানিতে আলুর অস্তিত্ব নেই। বরং এই আলু শুধু কলকাতার বিরিয়ানিতেই রাজত্ব করে। ঢাকা এবং বাংলাদেশের বিরিয়ানিতেও এই আলুর প্রভাব দেখা যায় — যার উৎসও কিন্তু কলকাতা।
নবাবের রসনা, বাবুদের দুর্বল হজমশক্তি, মধ্যবিত্তের পকেটের টান, কিংবা নতুন স্বাদের পরীক্ষা — সত্যিটা হয়তো সবটাই মিশে আছে একসঙ্গে। কিন্তু আজকের দিনে একটাই সত্য, আলু ছাড়া বিরিয়ানি অসম্পূর্ণ! কলকাতার মানুষ যেমন সিঙাড়ায় আলু না পেলে খুশি নন, তেমন বিরিয়ানির ডেকচিতে আলুর সোনালি ঝলক না থাকলে যেন স্বাদটাই অসম্পূর্ণ লাগে।
কলকাতার বিরিয়ানি আজ শুধু এক প্লেট খাবার নয়, এ এক ঐতিহাসিক যাত্রার গল্প — যেখানে নবাবের শৌখিনতা, বাঙালির খাওয়ার ঐতিহ্য আর সময়ের পরিক্রমায় গড়ে উঠেছে এক অমর স্বাদের উপাখ্যান। তাই আজও কলকাতার মানুষ মনে প্রাণে বলেন — “বিরিয়ানির সঙ্গে আলু থাকবে, এটাই আমাদের ঐতিহ্য, এটাই আমাদের ভালবাসা!