বহির্জাগতিক – নেদারল্যান্ডস ‘ রায়বাড়ীর পুজো ‘

দূর ইউরোপের নেদারল্যান্ডসের এক কোণে শান্ত ও ছিমছাম শহরতলিতে, প্রতি শরতে, এক ভিন্নরকম আবহ তৈরি হয়। আকাশজোড়া ধূনোর গন্ধ, ঢাকের বাজনার সুর এবং বাঙালিয়ানায় মোড়া একটি পরিবারে মা দুর্গার আহ্বান হয়। এটাই ‘রায়বাড়ীর দূর্গাপুজো’, যা এখন শুধুমাত্র একটি পরিবারের পুজো নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক ও ভালোবাসার মিলনক্ষেত্র।
পুজোর শুরু হয় ২০২১ সালে, যখন বেলজিয়ামের বাসিন্দা এক দম্পতি, লিপিকা এবং নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য, ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য নেদারল্যান্ডসে যান। কলকাতার দূর্গাপুজোয়, কলকাতায় মায়ের সাথে কাটানোর স্বপ্ন ছাপিয়ে, লিপিকা দেবী নতুন এক অভিজ্ঞতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পৌঁছান পল্লব ও রুমকির ছোট্ট বাড়িতে, যেখানে এই পুজোর আয়োজন হয়।
শুরুতে কিছু দ্বিধা অনুভব করছিলেন শ্রীমতি লিপিকা দেবী। আগের পুজোর অভিজ্ঞতা, খরচের হিসাব এবং উপবাসকালে অর্থদানের যে তিক্ততা তার মনে এক যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল, সেগুলো মেটানো বড়ই কঠিন ছিল। কিন্তু সে সবকে চাপিয়ে মায়ের প্রতি আকর্ষণে এবং পরিবারের আন্তরিক আমন্ত্রণে, তিনি সেখানে এসেই পড়লেন আর সেখানেই তিনি তাঁর সব চিন্তা সব দ্বন্দ্ব ভুলে, এক নতুন ঘর ও নতুন সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিলেন।


ত্রিপুরার পল্লব এবং কলকাতার রুমকির পরিবার – এই রায়বাড়ীর পুজো আয়োজন করেছে। তাঁদের সন্তান অদ্রিতা ও অঙ্কিত, এবং তাদের দুটি পোষ্য সারমেয়—ওরিও ও লিমো – এ যেন এক অসীম ভালোবাসার সংসার, যেখানে পুজোর দিনগুলোতে মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী রূপে উপস্থিত থাকেন। পল্লব এবং রুমকির জন্য এই পুজো বিশেষ অর্থবহ, কারণ তাঁরা নিজেদের মাতৃস্মৃতিকে হারিয়েছেন। তাই এই পুজো তাঁদের কাছে এক গভীর আত্মিক শ্রদ্ধাঞ্জলি হয়ে উঠেছে।
রায়বাড়ীর পুজোর একটি বিশেষ দিক হলো এখানকার ‘সেবায়ণ’ সংস্কৃতি। এই অনুষ্ঠান বনেদি বাড়ির ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে অতিথিদের জন্য দ্বিপ্রহরিক এবং রাতের খাবার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পরিবেশন করা হয়। এখানে কোনও মূল্য বা দানপত্রের বাক্সও চোখে পড়ে না। এই ধরনের সহজ দানে আত্মত্যাগের এই উদাহরণ আজকের যুগে এক বিস্ময়কর বিষয়। অনেকের মতে, খাওয়ার জন্যই এখানে এত ভিড় হয়, পুজো তার তুলনায় গৌণ। কিন্তু যারা সত্যভাবে এই অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, তারা জানেন যে, এটি মাত্র খাবার নয়—এটি আত্মিক তৃপ্তি এবং সম্পর্কের গভীর রসায়ন।
এই ২০২৫ সালে, পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করছে এই ‘রায়বাড়ীর পুজো’। যেটি সাথে সাথে এই পুজোর স্থানটিও আরো ব্যাপক আকারে স্থানান্তরিত হয়েছে। আগ্রহের পত্ৰ বৃদ্ধি পেয়েছে, অংশগ্রহণকারী সংখ্যা বেড়েছে—ডাচ নাগরিক থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষ সবাই নানাভাবে এই উৎসবে সামিল হচ্ছেন। কেউ পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন, কেউ প্রসাদ গ্রহণ করেন, আবার কেউ সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করে ভারতীয় ঐতিহ্যকে একটি নতুন দর্শনে দেখা উপভোগ করেন।
দশমীর সকালে ঘট বিসর্জনের শোভাযাত্রা যখন শুরু হয়, তখন চারপাশে নাচ-গানে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাচ পরিবারের সদস্যরা উপভোগ করে হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানান, কেউ কেউ বারান্দা থেকে সেই মুহূর্তের ছবি তোলে, আবার কেউ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেন— “এটা কি কোনও বিশেষ পারিবারিক উৎসব?” সেই সময়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই পূজা আজ সংস্কৃতির সীমানা অতিক্রম করে মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে।
এতকিছুর মধ্যেও লিপিকা দেবীর আজও মনে পড়ে যায় তার গত পাঁচ বছর মায়ের সাথে কলকাতার পুজোয় না থাকতে পারার সেই দুঃখ। তাই তার কৌতূহলী মন তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলে –
“মাগো, তুমি কি কষ্ট পাও, পাঁচ বছর পুজোতে তোমার কাছে যেতে পারিনি বলে?”
মা বলেন, “কষ্ট পাবো কেন? ঐ পূজার মধ্য দিয়েই তো তুই আমার কাছেই থাকিস…”
এটাই তো দুর্গাপুজোর প্রকৃত রূপ —
ভক্তি, ভালবাসা, ত্যাগ আর অন্তরের যোগাযোগ।
নেদারল্যান্ডসের রায়বাড়ীর পুজো সেই মানবিকতার, আন্তরিকতার এবং অসীম ভালবাসার এক অনবদ্য দলিল।

One thought on “বহির্জাগতিক – নেদারল্যান্ডস ‘ রায়বাড়ীর পুজো ‘

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *