চিত্রকলায় ফিরে দেখা দ্বায়বদ্ধতা

শিল্প হলো মানুষের আত্মার সঞ্চিত মধু
থিওডোর ড্রেইজার

শিল্প এবং মানুষ দুটি আলাদা শব্দ হলে-ও তাদের বসবাস একই সাথে। যদি প্রশ্ন আসে শিল্পের জন্ম কবে তাহলে বোধ করি উত্তরটা একই হবে। মানবের আর্বিভাব ও শিল্পের জন্মক্ষণ একইভাবে। শিল্পবোধ, আধুনিক ভাষায় যা নন্দনতত্ত্ববোধের কথা বলে থাকি তা আসলে ভাষা জ্ঞান হবার পর আমরা নানা সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেছি। তাহলে কি আগে মানবকুলের এই বোধ ছিলো না? তার প্রকাশের মাধ্যম ছিলো ভিন্ন আঙ্গিকে। মানুষ লেখায়,স্থাপনায়,রেখায় আরও নানা ভাবে উপস্থাপন করছে শিল্পবোধকে।ফলত শিল্প থাকে আত্নায়,এবং তা বোধের জন্ম দেয়। পৃথিবীর বয়স যত বেড়েছে শিল্প প্রকাশের বয়সও পরিপক্বতা বেড়েছে।

একটি জাতির সংস্কৃতি তার জনগণের হৃদয়ে এবং আত্মায় বসবাস করে
মহাত্মা গান্ধী

হোমো সেপিয়েন্স”  থেকে আজ অবধি মানুষ ভৌগোলিক এবং আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হইছে। তাদের ভাষা, খাদ্য, আচার-আচরণের ভিন্নতায় গড়ে উঠছে ভিন্ন সংস্কৃতি, তাদের শিল্পের নিজস্ব ভাষা তৈরি হয়েছে। আমার পেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন শিল্পরস,ভিন্ন আঙ্গিক।তাদের প্রকাশ তাদের জাতিগোষ্ঠী কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় সমগ্র পৃথিবীতে অভিন্ন তা হলো শিল্পসৃষ্টির রূপকার- দের এক দায়বদ্ধতা,এবং তা সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, সমগ্র মানবকূলের প্রতি।শিল্প সৃষ্টি শুধু মনতুষ্টি নয়।প্রকৃতির সৌন্দর্য তুলে আনায় একমাত্র কাজ নয় শিল্পের। প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে শিল্প এসেছে বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে; দিয়েছে নতুন নতুন দিকনির্দেশনা। শিল্পীর আত্মক্রন্দন দেখা যায় রেখায়,রঙে, ভাস্কর্যের মধ্যে দিয়ে। মানুষ আধিপত্যবাদকে পুঁজি করে ক্রমাগত ভাবে এই ধরণীকে অশান্ত করে তুলেছে এবং তার শিকার আরেকদল মানুষ। যুগে যুগে তারই প্রতিবাদ করেছে শিল্পীরা, শিল্পের ভাষায়। ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, শাসকের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে,রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে শিল্প ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে এবং তা শিল্পের দ্বায়। শিল্পী পাবলো পিকাসো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আঁকলেন তার প্রতিবাদের ভাষা “গোয়ার্নিকা” শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আঁকলেন ” বিদ্রোহ ” যা পৃথিবীর সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে নিজেকে মুক্ত স্বাধীন করবার এক অদম্য প্রচেষ্টা প্রকাশ পায়।

তেমনি আমাদের বাংলাদেশের চিত্রকলায় ৭০ দশক গুরুত্বপূর্ণ, একইসঙ্গে ৯০ দশক আরেকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জন্মের পূর্বক্ষণে দাঁড়িয়ে নানা আন্দোলনের অংশ একটি অংশে দাঁড়িয়ে, এবং শিল্পী সমাজ তা গভীরভাবে অবলোকন করেছে, অংশ গ্রহণ করেছে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ের প্রভাব শিল্পীদের রেখায়, রঙে পরবর্তীতে কিভাবে পড়েছিলো তা আমরা গ্যালারী কলা কেন্দ্রের যৌথ প্রদর্শনীতে দেখতে পাই। ৭০ থেকে ৯০ পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নানা ভাবে পরিবর্তন, ধর্মীয় রাজনীতির পীড়ণ, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিবর্তনের যে ঢেউ তা শিল্পীদের মননে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং তা রঙে, রেখায়,ভাস্কর্যে প্রকাশ করতে থাকে।আমাদের প্রতিবেশী ভূখন্ডে ১৯৬৮ সালে নকশাল বাড়ি আন্দোলন তখন তুঙ্গে তার প্রভাবও লক্ষণীয়।পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকার গণহত্যা চালাচ্ছে, রাজনৈতিক হত্যা চলমান এবং ধর্মীয় কুসংস্কার ব্যবহার করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, ফলত শিল্পীদের মনস্ক জগতে স্থিরতার বৈপরীত্যে ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে, অসুন্দর হানা দিচ্ছে রেখায়, রঙে ক্যানভাসে ভৎর্সনার প্রকাশ। এই অস্থিরতা চলমান এবং ৮০ দশকে সৃষ্ট হয় শিল্প দল ” সময়”।তাদের শিল্পসৃষ্টিতে যতোটা না প্রকৃতির স্নিগ্ধতার গল্প তারচেয়ে ঢেড় রাজনৈতিক সচেতনা, ধর্মীয় বোধ, মানবিক বিবেক এবং সামাজিক অসংগতির গল্প।১৫ জন শিল্পীর বিবেক যেন একটিতে পরিণত হয়েছে।

শিল্পী রুহুল আমিন কাজলের ছবির শিরোনাম “Society “। সমাজ কে ক্যানভাসবদ্ধ করেছেন তা সুন্দরের পেলব তায় নয়,তা ভৎর্সনাময়। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের বলিষ্ঠ রেখা চিত্র বারংবার আমাদের দেখায় রাজনৈতিক লোলুপ দৃষ্টিতে একদল মানুষরূপী পশুজাত যা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে। শিল্পী দিলারা বেগম জলির চিত্রে ধর্মের আখ্যানকে ব্যবহার করে সমাজকে, নারীকে অবদমনের এক নগ্নরূপ ধরা পড়ে। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান যুদ্ধের কারণ যে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা তা সেই ৮০ দশকেই দেখিয়েছেন।

চিত্রকলা যখন আপনি জানেন না তখন সহজ,কিন্তু যখন জানেন তখন খুবই কঠিন।
এডগার ডেগাস

ফিরে দেখা ৭০ থেকে ৯০ প্রদর্শনীতে একটি বিষয় দারুণ ভাবে স্পষ্ট তা হলো, সমাজ এবং তার গঠনের ত্রুটিপূর্ণ অবস্থান। শিল্পী জুইস “মোহাচ্ছন্ন সমাজ” শিরোনামে যে ধারাবাহিক চিত্র রচনা করেছিলেন তাতে ধর্মীয় রাজনীতির নামে সমাজ ও সাধারণ মানুষের মাঝে যে বিভক্ত তৈরি করেছে একদল মানুষ তাদের অদৃশ্য হাত স্পষ্ট। শিল্পী হাবিবুর রহমানের লিথোগ্রাফিতে দেখা যায় ৮০ দশকে তিনি সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈপরীত্যেকে নানা প্রতীকী ব্যবহার করেছেন।কুকুরকে নানা আঙ্গিকে দেখিয়েছেন মৃদু ফর্মে ও বর্ণে।

শিল্প একই সাথে নিজেদের খুঁজে পেতে এবং হারিয়ে যেতে সক্ষম।
থমাস মার্টন

ফিরে দেখা ” প্রদর্শনী আমাদের খুঁজে পেতে সাহায্য করে। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ধারণ করে নয়, তা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সবমিলিয়ে শিল্পের ভাষা ব্যবহার করে। এই শিল্পীরা তখন যে সৃষ্টি করেছেন তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং তা বর্তমানেও। এই শিল্পীরা দেশের কাছে কতটা দায়বদ্ধতা প্রয়োগ করেছেন ক্যানভাসে, এবং সেই দায় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক তখন এবং এখন।

রেজাউর রহমান
চিত্র শিল্পী ও লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *