‘বলি ও ননদী আর দুমুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে’ অথবা ‘বড়লোকের বিটি লো’—এই গান দুটির নাম শুনলেই ভেসে আসে এক সুমধুর কণ্ঠ। এই গানগুলি কেবল জনপ্রিয় নয়, বাংলার লোকসংগীতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে। আর সেই কণ্ঠ যাঁর, তিনি স্বপ্না চক্রবর্তী। আশি ও নব্বইয়ের দশকে যাঁর ক্যাসেট বিক্রির সংখ্যা লতা মঙ্গেশকরকেও বিস্মিত করেছিল। অথচ, আজ সেই শিল্পী বেঁচে আছেন নিঃসঙ্গভাবে, রেশনের চাল আর স্বামীর সামান্য পেনশনেই চলছে তাঁর দিন। নেই কোনও সরকারি সহায়তা, মেলেনি কোনও শিল্পী ভাতা।
সঙ্গীতচর্চার শুরু: ছোট বয়সেই শিল্পীর উড়ান
১৯৫০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বীরভূমের দেরপুর গ্রামে জন্ম স্বপ্না চক্রবর্তীর। বাবা নিত্যগোপাল চৌধুরী ও মা সরলাবালা দেবীর আদরের কন্যা স্বপ্না মাত্র সাত বছর বয়সেই সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি নেন। তাঁর বেড়ে ওঠা সিউড়ি শহরে, আর সেখান থেকেই গানের প্রতি তাঁর গভীর টান জন্ম নেয়। বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে টানা পাঁচ বছর রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নেন তিনি। একই সঙ্গে ভক্তিগীতি, লোকগান এবং আধুনিক গানে তৈরি করেন নিজস্ব জায়গা।
তালিমের প্রাপ্তি: কিংবদন্তীদের ছায়াতলে বিকশিত প্রতিভা
স্বপ্নার কণ্ঠসাধনার পথ সহজ ছিল না, তবে ছিল মহান গুরুদের আশীর্বাদ। অংশুমান রায়, প্রবীর মজুমদারের মতো শিল্পীদের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার পর তিনি গান শিখেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা ও ভি বালসারার মতো মহারথীদের কাছে। তাঁদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে থেকে তিনি পেয়েছেন আত্মবিশ্বাস, পেয়েছেন শিল্পীসত্ত্বার আসল চেতনা।
প্রথম সাফল্য: দুই গানেই দেশ মাতোয়ারা
১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর দুটি কালজয়ী গান—আশানন্দন চট্টরাজের লেখা ‘বলি ও ননদী…’ ও রতন কাহারের লেখা ‘বড়লোকের বিটি লো…’। এই গান দুটির মাধ্যমেই গ্রামবাংলা থেকে শহরের প্রতিটি গৃহস্থ বাড়ি কেঁপে উঠেছিল তাঁর গলায়। গান দুটি শুধু শ্রোতার মন ছুঁয়েছিল না, বিপুল সংখ্যায় ক্যাসেটও বিক্রি হয়। এমনকি এই বিক্রি দেখে কিংবদন্তী লতা মঙ্গেশকর পর্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
লোকগানের মুকুটহীন রানি: হাজারো অনুষ্ঠানের প্রিয় শিল্পী
এই দুটি গান প্রকাশের পর থেকে তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক রেকর্ড আসতে থাকে—‘শুন রাঙা সইলো’, ‘আমার ঘরে টিভি’, ‘বাঁধনা পরবের দিন’, ‘সজনে গাছে শুয়ো পোকা’, ‘জব চার্নকের কলকাতা’ ইত্যাদি অসংখ্য লোকগান তাঁকে এনে দেয় স্থায়ী জনপ্রিয়তা। দেশজুড়ে তো বটেই, বাংলাদেশেও বহুবার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছেন তিনি।
চলচ্চিত্রে পদচারণা: গানের পর্দার যাত্রা
১৯৮৬ সালে ‘অচেনা মুখ’ ছবিতে প্রথম প্লে-ব্যাক করেন স্বপ্না। এরপর ‘আব্বাজান’, ‘দাহ’, ‘মৌন মুখর’, ‘জীবন অনেক বড়’, ‘অন্যমুখ’ সহ একাধিক ছবিতে গান গেয়ে প্রশংসিত হন। লোকগান থেকে চলচ্চিত্র সঙ্গীত—সব জায়গাতেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ।
সম্মাননা আর পুরস্কার: রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি
আকাশবাণী তাঁকে ১৯৭৫ সালে ‘বি-হাই’ শিল্পীর সম্মান দেয়। এরপর একে একে আসতে থাকে সম্মাননা—১৯৯০ সালে সাহিত্য অকাদেমি, ১৯৯৪ সালে ‘শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার’, বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদের ‘লোকসঙ্গীত সম্রাজ্ঞী’ খেতাব, ত্রিপুরার ‘শ্রেষ্ঠ পল্লীগীতি’ সম্মান এবং বাংলাদেশের ‘পল্লীকন্যা’ উপাধি। এছাড়াও পেয়েছেন মান্না দে স্মৃতি পুরস্কার ও ‘বাংলার গৌরব’ সম্মান। কিন্তু আজও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো জাতীয় সম্মান বা স্থায়ী ভাতা মেলেনি।
বর্তমান জীবন: খ্যাতির মঞ্চ থেকে নিঃসঙ্গ জীবনে পতন
আজ ৭৫ বছরের শিল্পী স্বপ্না চক্রবর্তী সিউড়িতে একটি ছোট বাড়িতে একা থাকেন। বছর দুই আগে স্বামী মানস চক্রবর্তীর মৃত্যু তাঁর জীবনে আনে আরও শূন্যতা। ঘরের এক পাশে স্তূপ করে রাখা স্মারক, ব্যাজ, পুরস্কার আর সেগুলোর পাশে স্বপ্না চক্রবর্তী। রেশনের চাল আর সামান্য পেনশনের টাকায় কাটে তাঁর জীবন। জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছেও সাহায্যের আবেদন করেছেন, কিন্তু কোনও সাড়া পাননি।
আক্ষেপের সুরে শিল্পীর অভিযোগ
নতুন প্রজন্ম তাঁর গান গায় ঠিকই, কিন্তু উচ্চারণে ভুল থাকায় গানগুলোর মানে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, “আমি তো এখনও বেঁচে আছি, কেউ চাইলে ঠিক বলে দিতে পারি।” একবার ঊষা উত্থুপ তাঁর গান গেয়ে ভুল করায় সরাসরি বলেছিলেন সেটা—ঊষাদিও পরে স্বীকার করেন ভুল হয়েছে।
স্বপ্নার বিশ্বাস: লোকগান হারিয়ে যাবে না
সবশেষে শিল্পী বলেন, “লোকগীতি কোনওদিন হারিয়ে যাবে না। লোকগান হল সব গানের মা—আর মা তো হারিয়ে যায় না।” এই কথাগুলিই যেন তাঁর অটুট বিশ্বাস, তাঁর গান, তাঁর আত্মমর্যাদার প্রতীক।
এতসব সাফল্যের পরও যখন এই শিল্পী সরকারের পক্ষ থেকে সামান্য সহানুভূতিও পান না, তখন প্রশ্ন ওঠে—সংস্কৃতির জন্য যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেন, তাঁদের প্রকৃত মর্যাদা আমরা কি দিতে পারছি?