হিন্দু ধর্মে ‘আপসমার’ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। এটি শুধুমাত্র একটি পৌরাণিক বামন (বামনাকৃতি দানব) নয়, বরং আত্মিক অজ্ঞানতা, অহংকার ও বিভ্রান্তির রূপক। নটরাজ রূপে শিব যখন বিশ্বজগতের নৃত্য করছেন, তখন তিনি এই আপসমারের ওপর পা রেখেছেন। এই চিত্রটি গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বহন করে — যেখানে শিব জ্ঞানের প্রতীক এবং আপসমার অজ্ঞানতার।
আপসমারকে হত্যা না করে তাকে চেপে রাখা হয়েছে, যা এই বার্তা দেয় যে অজ্ঞানতাকে পুরোপুরি নষ্ট করা যায় না; বরং একে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় আত্মসচেতনতা, ধ্যান ও আত্মজ্ঞান দিয়ে। এটি বোঝায়, মোক্ষ বা মুক্তি পেতে হলে নিজ অহংকার, মায়া ও মানসিক দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে তাকে পদদলিত (অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত) করতে হয়।
আবার আয়ুর্বেদ ও প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘আপসমার’ বলতে বোঝানো হয় এক ধরণের গুরুতর স্নায়ুবিক রোগ, যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৃগী রোগ (Epilepsy) নামে পরিচিত। সংস্কৃত শব্দ “আপ” (অর্থাৎ হারানো) ও “স্মার” (অর্থাৎ স্মৃতি) থেকে ‘আপসমার’ শব্দটি এসেছে, যার মানে স্মৃতিভ্রংশ বা জ্ঞান হারানো।
আচার্য চরক ও অন্যান্য আয়ুর্বেদাচার্যগণ আপসমারকে দোষবিকার (বাত, পিত্ত, কফ) ও মানসিক অস্থিরতার ফল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রোগীর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে: হঠাৎ খিঁচুনি, জ্ঞান হারানো, মুখে ফেনা ওঠা, অঙ্গসঞ্চালনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো ইত্যাদি।
আপসমারকে নিয়ে আধ্যাত্মিক ও চিকিৎসাশাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি, উভয়েই একত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়—জীবনে ভারসাম্যের প্রয়োজন। এটি হোক মানসিক বা শারীরিক, অশান্তি ও অজ্ঞানতা তখনই নিয়ন্ত্রণে আসে যখন আমরা সচেতনভাবে জ্ঞান, শৃঙ্খলা ও অভ্যাসের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করি।
আপসমার আমাদের শেখায়, অজ্ঞানতা ও রোগ — উভয়ই মানব জীবনের অংশ; তবে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চা থাকলে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।