উত্তমকুমারের স্মৃতিচারণে মৌসুমী, ফিরে এল ‘চা-শিঙাড়া’র দিনগুলো

বছর কেটে গেছে অনেক, তবু যেন ঠিক চোখের সামনেই রয়েছেন উত্তমকাকু। সময়ের সঙ্গে কিছু স্মৃতি আবছা হয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ের ফ্রেমে যাঁরা গেঁথে থাকেন, তাঁদের জায়গা কখনওই ফিকে হয় না। উত্তম কুমার — যাঁকে এক শব্দে ‘মহানায়ক’ বললেই সব বলা হয়ে যায়। কিছুদিন আগে একটি সাক্ষাৎকারে অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “উত্তম কুমার আকাশের সেই সূর্য, আর বাকি সবাই শুধু নক্ষত্র।” কথাটা যতটা নিছক তুলনা মনে হয়, ততটাই গভীর এক বাস্তব। কারণ যাঁরা সেদিনের সেই স্বর্ণযুগে ছিলেন, তাঁরা জানেন উত্তমকুমার মানেই এক আলাদা অধ্যায়।

তবে এমন একজন কিংবদন্তিকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই কেমন যেন দ্বিধা আসে মনে। কারণ তিনি তো আর আজ পাশে নেই, ভুল কিছু বললেও সংশোধনের সুযোগ নেই। অনেক কিছু জানলেও, কিছু না বলাই যেন শ্রদ্ধার। এ রকম মানুষের ক্ষেত্রে সবটা না বলেই ভালো। মনের মধ্যে রয়ে যাক শুধু ভালোবাসা, স্মৃতি আর মমতামাখা কিছু মুহূর্ত।

আমি যখন অভিনয়ের জগতে এসেছি, তারও আগে থেকে উত্তমকাকুকে চিনি। তিনিও আমাকে চিনতেন ছোটবেলার কাজ—‘বালিকা বধূ’ থেকেই। বরাবর স্নেহ পেতাম ওঁর কাছ থেকে। বাড়িতে গেলে গৌরী কাকিমা কী যত্ন করে খাওয়াতেন, তা এখনও অনুভবে টাটকা। আমার শ্বশুরমশাই, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ওঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তাই আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল প্রায়ই। সম্পর্কের সেই আন্তরিকতা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।

এই সময় বলতেই হয়, একজন মানুষ যত বড়ই হন না কেন, তাঁকে ঘিরে থাকা মানুষরা সবসময় তাঁর মঙ্গল চায় না। উত্তমকাকুর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে তরুণ কুমার, যাঁকে আমরা ‘বুড়ো কাকু’ বলে ডাকতাম, তিনি ছিলেন উত্তমকাকুর জন্য নিঃস্বার্থ শুভাকাঙ্ক্ষী। ঠিক তেমনি ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়—যাঁর কথা শুনতে অনেকে কঠিন বললেও, তিনি সর্বদা সত্য কথা বলতেন। উত্তমকাকু ছিলেন ভীষণ সরল ও সংবেদনশীল। সবকিছু বুঝতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। সেটা ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা অসাধারণ দিক।

‘আনন্দ আশ্রম’-এর পর আমি আবারও উত্তমকাকুর সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পাই ‘ওগো বধূ সুন্দরী’তে। এই ছবির শুটিংয়ের সময় একটি ঘটনা আজও স্পষ্ট মনে আছে। আমি কলকাতায় এলে স্টুডিয়োর আশেপাশে চা-শিঙাড়া খেতে খুব ভালোবাসতাম। একদিন স্টুডিওর বাইরে বেঞ্চে বসে সবে শিঙাড়ায় কামড় দিয়েছি, এমন সময় ওপরের বারান্দা থেকে উত্তমকাকু মজা করে বললেন, “আমার জন্যও শিঙাড়া রাখবি কিন্তু!” আমি তো অবাক—এত বড় মানুষ তিনি, চা-শিঙাড়ার প্রতি এমন টান! সেদিন সত্যিই বেঞ্চে বসেই মজা করে আড্ডা দিয়েছিলাম, খেয়েছিলাম একসঙ্গে।

এই হাসির মুহূর্তের খুব বেশি দিন পরেই এল সেই দিন, যেদিন শুটিং চলাকালীন খবর এল—উত্তমকাকু আর নেই। পুরো ইউনিট মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা জানেন ছবির একটা দৃশ্যে উত্তমকাকুকে সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, যেখানে তিনি বারে বারে বুকে হাত দেন—সম্ভবত সেখানেই অসুস্থতার শুরু। পরের দিন আমাদের বাড়িতে আসার কথা ছিল তাঁর, কিন্তু সেটাই হয়ে উঠল না আর।

তারপর বহু নায়ক এলেন, চলে গেলেন—কেউ হয়তো বড় হলেন, কেউ জনপ্রিয়। কিন্তু ‘মহানায়ক’ উত্তম কুমারের জায়গা কেউ নিতে পারলেন না। তিনি শুধু এক কিংবদন্তি ছিলেন না, ছিলেন এক যুগ, এক আভিজাত্য, এক অনুভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *