আহমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনায় ২৪৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু

আজ দুপুরটা আহমেদাবাদের জন্য আর পাঁচটা সাধারণ দুপুরের মতো ছিল না।

আকাশ ছিল পরিষ্কার, বিমানবন্দরের রানওয়ে জুড়ে ছিল ব্যস্ততার পরিচিত ছবি। ঘড়ির কাঁটা যখন স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৩৮ ছুঁয়েছে, তখন এক বিশাল বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার তার ইস্পাতের ডানা মেলে মাটি ছেড়েছিল। তার পেটের গভীরে ছিল ২৪৪টি প্রাণ, ২৩২ জন যাত্রী আর ১২ জন ক্রু সদস্য।

তাদের গন্তব্য ছিল লন্ডন, কারও চোখে ছিল নতুন জীবনের স্বপ্ন, কারও মনে ছিল বিদেশে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকুলতা। কতজন ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দিচ্ছিল, কত পরিবার ছুটি কাটাতে যাচ্ছিল, কত মানুষ ফিরছিল নিজের কর্মস্থলে। উড়ানের মুহূর্তে জানালার ধারে বসা যাত্রীরা হয়তো দেখছিলেন, কীভাবে তাদের প্রিয় শহরটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে, তারা জানতেন না, এই দেখাই শেষ দেখা।

উড্ডয়নের ঠিক পরেই, কন্ট্রোল রুমের রাডার স্ক্রিন থেকে হঠাৎই উধাও হয়ে যায় বিমানটির সবুজ বিন্দু। ফ্লাইটরাডারের শেষ তথ্য অনুযায়ী, বিমানটি তখন মাটি থেকে মাত্র ৬২৫ ফুট উচ্চতায় ছিল এবং তখনও উপরে ওঠার চেষ্টা করছিল। আর তার পরেই নেমে আসে সেই ভয়ংকর, অনন্ত নিস্তব্ধতা। সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কয়েকশো টন ওজনের একটি যন্ত্র, ভেতরে জীবন্ত মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তখন পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এক অনিবার্য পরিণতির দিকে ছুটে চলেছে।

এরপরই সেই ভয়ংকর মুহূর্ত। আহমেদাবাদের মেঘনীনগর এলাকার আকাশ চিরে একটি বিকট শব্দ নেমে আসে। স্থানীয় বাসিন্দারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তাদের চোখের সামনে এক বিশাল আগুনের গোলা হয়ে ভেঙে পড়ে বিমানটি। একটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের ওপরে আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই, বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা।

মুহূর্তের মধ্যে জ্বালানি তেল আর বিমানের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে, দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে লেলিহান অগ্নিশিখা। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী এতটাই ঘন ছিল যে, তা ঢেকে দিয়েছিল দুপুরের সূর্যকে। সবকিছু এক মুহূর্তে গ্রাস করে নিল সেই বিধ্বংসী আগুন আর ধ্বংসযজ্ঞ।

খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই বেজে ওঠে সাইরেন। দমকলের একের পর এক গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর জওয়ানরা ছুটে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার, তা ঘটে গেছে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ আর আগুনের তীব্রতার মধ্যে উদ্ধারকার্য চালানো ছিল এক দুঃসাধ্য লড়াই। বাতাসে ভাসছিল পোড়া গন্ধ আর একরাশ অসহায় আর্তনাদ।

স্বজন হারানোর আশঙ্কায় মানুষ ছুটে আসছিল ঘটনাস্থলের দিকে, তাদের প্রত্যেকের চোখে ছিল শুধু একটাই প্রশ্ন, আমার প্রিয়জন কি বেঁচে আছে?

এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত, হতাহতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে সরকারিভাবে কোনো বিবৃতি আসেনি, তবে যে ভয়াবহ দৃশ্য উঠে আসছে, তাতে এক বিশাল মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট। এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করে নিয়েছে এবং সরকার উচ্চপর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।

কিন্তু কোনো তদন্ত বা কোনো বিবৃতি কি ফিরিয়ে দিতে পারবে সেই ২৪৪টি প্রাণ যেরকম ভাবে তারা মাটি ছেড়েছিল? ফিরিয়ে দিতে পারবে সেইসব ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন, অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া ফোনালাপ, আর শেষবারের মতো না বলা কথাগুলো?

আজকের এই দুর্ঘটনা শুধু কিছু সংখ্যার হিসেব নয়। এটা শত শত পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার শব্দ। এটা সেইসব মানুষের শেষ যাত্রার এক করুণ ইতিহাস, যারা ভেবেছিল আকাশপথে তারা পৌঁছে যাবে নিজেদের গন্তব্যে, কিন্তু তার বদলে তারা হারিয়ে গেল আগুনের শিখায়।

ভারতের অসামরিক বিমান পরিবহণের ইতিহাসে আজকের এই দিনটি এক কালো অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে। আজকের আকাশটা আর আগের মতো নীল নেই, আজকের আকাশ শোকের রঙে ঢেকে গেছে। যারা বেঁচে গিয়েছেন তারা প্রাণের জন্য বীভৎস লড়াই করছেন, এবং যারা চলে গিয়েছেন, তারা জানলেনই না যে পৃথিবীতে যে তারা আর ফেরত আসতে পারবেন না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *