নৃত্যের জগতে: অমিতা দত্ত ও কত্থকের ছন্দ

প্রফেসর অমিতা দত্ত সমসাময়িক ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের একজন সুপরিচিত উদাহরণ। তিনি একজন অধ্যাপিকা, নৃত্যশিল্পী, পরিচালক, শিক্ষিকা, পণ্ডিত, সমালোচক এবং কলামিস্ট। কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি পারফর্মিং আর্টস সেন্টারের পরিচালক, চারুকলা অনুষদের ডিন, নৃত্য বিভাগের প্রধান এবং উদয় শঙ্কর নৃত্য অধ্যাপিকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি সর্বভারতীয় সঙ্গীত-ও-সংস্কৃতি পরিষদে সহ-সভাপতি হিসেবে এক অনন্য নেতৃত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

গুরু পন্ডিত বিরজু মহারাজ ও পন্ডিত মায়াধর মহারাজের কাছ থেকে প্রোফেসর অমিতা দত্ত কত্থক নৃত্যের প্রশিক্ষণ নেন এবং এই শাস্ত্রীয় ধারাকে  নিজস্ব অভিব্যক্তি, সৌন্দর্যবোধ ও সৃষ্টিশীলতার মেলবন্ধনের মাধ্যমে এক নতুন আঙ্গিক প্রদান করেন। তিনি তাঁর পরিবেশনা, সৃজনশীল নৃত্য পরিচালনা, আলোচনা, সাক্ষাৎকার, বই এবং কর্মশালার মাধ্যমে, দেশে এবং বিদেশে কত্থক ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার অব্যাহত রেখেছেন। সেই সুবাদে প্রফেসর দত্ত বহু ভ্রমণও করেছেন এবং দেশে -বিদেশে অনেক পুরস্কারের দ্বারা সম্মানিতও হয়েছেন।.

প্রফেসর দত্তের দৃষ্টিতে কত্থকের ব্যাখ্যা

কত্থক, প্রফেসর দত্তের কাছে কেবল মাত্র এক প্রকার নৃত্বশৈলীই নয়, এটি হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনের এক বিশিষ্ট অংশ – যা তাঁর চিন্তা, দর্শন ও নৃত্যচর্চার গভীরে গেঁথে রয়েছে। তাঁর প্রত্যেকটি পরিবেশনাতেই কত্থকের বল, ভাব, মুদ্রা ও কাহিনী মিশে হয়ে ওঠে এক জীবন্ত ইতিহাস ও সংস্কৃতি।

যখন অঙ্গের মাধ্যমে কথা, আঁখি মাধ্যমে অনুভবের ভাষা এবং ছন্দের মাধ্যমে রচিত হয় গল্প – সেই মিশরণেই গঠিত হয় কত্থক। এই নৃত্যশৈলির সৃষ্টি “কথা” শব্দটির থেকে। “কথা” অর্থাৎ গল্প আর যারা গল্প বলেন তারাই “কত্থক”। কথিত আছে “কথা কহে সো কথিক (কত্থক) কহাবে” অর্থাৎ যে কথা বলে তাঁকে কাথিক বা কত্থক বলে। সাহিত্যে এমন কিছু শ্রেনীর প্রমাণ মেলে যারা পরবর্তীকালে মহাকাব্য, ধর্মগ্রন্থ থেকে পৌরাণিক কাহিনীগুলি গান, নাটক ও নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করতেন। যাদের মূল লক্ষ্য ছিল বিনোদনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার প্রসার করা। ধীরে ধীরে এটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে উত্তর ভারতের নানা স্থানে যেমন উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লী এবং পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের নানা অংশে। এই ভাবেই এই শ্রেনীর মানুষেরা সমাজের এক স্বতন্ত্র অংশ হয়ে ওঠে এবং তাদের মৌখিক ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উত্তরাধিকার সূত্রে চলতে থাকে। এই গ্রামীণ গায়কেরা উত্তর ভারতের মন্দির থেকে মুঘলের রাজদরবার হয়ে আজ এই আধুনিক মঞ্চে এসে পৌঁছেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারতিও নানান ভাবে বিকশিত হয়ে এবং বর্তমানে সেই কত্থক তিনটি ঘরানায় বিভাজিত হয়ে থাকে, তা হলো, লখনউ ঘরানা, জয়পুর ঘরানা ও বানারাস ঘরানা।

কত্থকের মূল উপাদান

এছাড়াও কত্থকের তিনটি মূল উপাদান রয়েছে, যা হলো, নৃত্ত, নৃত্য ও নাট্য। নৃত্ত হলো ছন্দনির্ভর এমন এক আলংকারিক নৃত্য যেখানে লয়ের বৈচিত্র্যের সাথে সাথে তালের সৌন্দর্য লক্ষ্য পায়। নৃত্য হলো শারীরিক গতি, হস্তমুদ্র ও মুখাভিনয়ের মধ্য দিয়ে ভাবের প্রকাশ।আর নাট্য হলো কাহিনিনির্ভর চরিত্র ও ঘটনার উপস্থাপনা, যার মূল অংশ হলো ভাব ও নাটকীয়তা। কত্থকে নৃত্যশিল্পী ও সংগীতজ্ঞের মধ্যে তাল ও লয়ের চমৎকার সমন্বয়ে তাৎক্ষণিক ছন্দ – রচনার মাধ্যমে এক গতিশীল ও সৃষ্টিশীল পরিবেশ তৈরি হয়, যা এটিকে অন্য যেকোনো নৃত্যশৈলীর থেকে আনেকটাই আলাদা করে দেয়।

কত্থক শিক্ষা পরিবেশনায় সময়ের ছোঁয়া

প্রাচীনকালে কত্থক প্রশিক্ষণ হতো গুরু – শিষ্যের পরম্পরার মতন। গুরুর গৃহে হতো কঠোর অনুশীলনী, তাল, পায়ের কাজ, মুখাভিনয় ও সঙ্গীত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে সেই পদ্ধতির মধ্যে অনেকটাই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এখন গুরুর গৃহে নয় কোনো একাডেমি বা ব্যক্তিগত কোনো প্রতিষ্ঠানে এই চর্চা লক্ষ্য করা যায়। আগে এক ঘরানায় থেকেই চলতো প্রশিক্ষণ কিন্তু এখন বিভিন্ন গুরুর সান্নিধ্যে ছাত্র – ছাত্রীরা শিল্পচর্চার শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে, যার ফলে ঘরানার সীমারেখা ম্লান হয়ে এসেছে। আজকাল মঞ্চে কত্থক পরিবেশনার এক নির্ধারিত কাঠামো থাকে – বন্দনা থেকে শুরু করে ধীর, মধ্য ও দ্রুত লয়ের নৃত্ত ও ভাবনৃত্য এবং শেষ হয় ভজন বা ঠুমরী না তারানা দিয়ে। তবে সময়ের সাথে সাথে কত্থকের রূপ-রং-কাঠামো সবের মধ্যে পরিবর্তন এলেও তাঁর যে অন্তর্নিহিত রস, সৌন্দর্য ও প্রাণশক্তি আজও বজায় রয়েছে ঠিক আগেরই মতন ভাবে। শ্রদ্ধা, সাধনা ও সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে এই নৃত্তধারা আজও আরো প্রখর ভাবে জীবন্ত রয়েছে এই নতুন প্রজন্ম মাঝে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *