চিত্রে বাস্তবতা, হৃদয়ে শিল্প, এই দুই মিলিয়েই রঙে লেখা বিকাশ ভট্টাচার্যের জীবন

সাল তখন ১৯৪০, তারই ২১ সে জুন পরাধীন ভারতের বুকে জন্ম নিয়েছিলেন এক অসামান্য চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য। কলকাতার এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই শিল্পী তাঁর বেড়ে ওঠার সময় কলকাতার রাজনৈতিকভাবে উত্তাল পরিবেশ থেকে তাঁর চাক্ষুষ ও বৌদ্ধিক আদর্শ সংগ্রহ করেছিলেন যা পরবর্তীকালে তাঁর শিল্পকার্যের মধ্যেও ধরা পড়ে। তাঁর চিত্রকলার মাধ্যমই ছিল সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন, তথা তাদের আশা – আকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু করে দুর্নীতি – ভন্ডামি পর্যন্ত সবটাই।
ভট্টাচার্য খুব কম বয়সেই তাঁর পিতাকে হারান, যার ফলে তাঁকে ছোটবেলা থেকেই বছর জন্য অনেক সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয় আর সেই সংগ্রামকে সাথে নিয়েই তিনি ১৯৬৩ সালে ইন্ডিয়ান কলেজ অফ আর্টস এন্ড ড্রাফটম্যানশীপ থেকে চারুকলায় ডিপ্লোমা নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীকালে সেই কলেজেই শিক্ষকতাও করান বহুবছর।
তিনি তেল রং, অ্যাক্রালিক, জল রং, কনটে এবং কোলাজে কাজ করেছেন। কিন্তু তিনি কাজ শেখাতেন পেন্সিলে বা জল রঙে। জানা যায় তাঁর পেন্সিলের কাজ ঘোষে নয়, সম্পন্ন হতো স্ট্রোকের দ্বারা। এবং তাঁর ছাত্রদের থেকেই জানা যায়, সেগুলি এতটাই নিখুঁত হতো যে আলো – ছায়ায় মিশিয়ে গেলেও রেখাগুলি গুণে নেওয়া যেত স্পষ্টভাবে। তাঁর কাছে পেন্সিল ছিল গুরু বা ঈশ্বরের সমান। তাই তিনি তাঁর মেয়ে বলাকা বলে গেছিলেন ড্রয়িং শুরুর আগে প্রেন্সিলকে প্রণাম জানাতে।
তাঁর প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের থেকে আরও জানা গেছে যে তিনি ক্লাসরুমের ক্লাসের সাথে সাথে আউটডোর ক্লাসও বহু করাতেন। তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রায়শই চলে যেতেন ধর্মতলার ইডেন গার্ডেনে। নেতাজি ইন্দোরও গড়ে ওঠেনি সেই সময়। তাই সেই একটা ছোট্ট জলাশয় সহ সেই বিপুল মাঠটি ছিল তাদের আউটডোর ক্লাসরুম আর ওখানের মডেল হিসেবে সেজে উঠত প্রকৃতি নিজেই। বাবুঘাট আর বিশাল গঙ্গা আর গঙ্গার ধার বেয়ে ছিল সহস্র ‘ ছবির বিষয় ‘।
আউটডোর ক্লাসরুমে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয় শিক্ষক অর্থাৎ প্রফ ভট্টাচার্য নিজেও শিল্পচর্চা করতেন। কিন্তু নিজের কোনো রং বা কাগজ না নিয়ে যাওয়ায় ছাত্রদের শিল্পকর্ম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমই তাঁর শিল্পচর্চার মাধ্যম। তিনি তিন ভিন্নভাবে এর পরিণতি ঘটাতেন।
প্রথমে, ড্রয়িং হলে অন্যের কাজের পাশে একটাই জিনিসের নানান ভাবে পরিবেশনা করা। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীদের ভুল সংশোধনের পাশাপাশি সেটির উন্নতমানের উপায়গুলোও দেখিয়ে দিতেন।
দ্বিতীয়, জলরঙের বিষয় হলে হয় অন্যদের কাজের আংশিক বা কাজের ওপরে কাজ করে ফিনিশিং টা বুঝিয়ে দিতেন।
আর তৃতীয় ধরণটি হল সেই কাগজে কাজটি সম্পূর্ণটাই তাঁর হাতে করা থাকতো। তাই এই পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীদের কাছে ছিল সবচেয়ে প্রিয়। এই শেষের পদ্ধতিটি বাস্তবায়ন করার জন্য ছাত্রছাত্রীরা তাদের সরঞ্জাম এগিয়ে দিয়ে প্রফেসরকে বলতেন “স্যার, কিভাবে শুরু করব আর কিভাবে সম্পন্ন করব জলরঙের একটা কাজ, আপনি যদি পুরোটা দেখান।” ব্যাস, তিনিও করে দিতেন। আর যার খাতায় হয়ে যেতো সেটা তার সম্পত্তি।
সমীর মন্ডল, তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র, তিনি জানান আউটডোর ক্লাসরুমে এই ধরণের মালিকানার অধিকারী তিনি হয়তো হতে পারেননি, তবে একদিন ক্লাসরুমে প্লাস্টারের মূর্তি দেখে পা আঁকার সময় যেই না মুখ ফসকে বলেন ” স্যার, এটা তো জ্যান্ত মানুষের পা দেখেও অনুশীলন করতে পারি? ” অমনি সেই প্লাস্টারের মূর্তি বদলে তাকে দাঁড় করিয়ে প্রফেসর ভট্টাচার্য নিজেই এই প্রাক্তন ছাত্রের খাতায় তাঁর পেন্সিলের ছোঁয়ায় পা টা এঁকে ফেলেন। তাতে সমীরবাবু প্রফেসরের হাতে স্পর্শ পেলেও, খাতায় গুরু তার পা আঁকার পাপের ভার তিনি সারা জীবন নিজের কাঁধে বহন করেছেন বলেই জানিয়েছেন।
এবার আসা যাক প্রফেসর ভট্টাচার্যের শিল্পী জীবনে। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের এক এমন চিত্রশিল্পী যিনি তাঁর চিত্রের মাধ্যমে বারংবার বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তৎকালীন ভারতীয় শিল্পীদের সামনে যারা তখন বিকৃত এবং বিমূর্ততার দিকে ঝুঁকেছিলেন। তিনি তাছাড়াও ছিলেন একজন দক্ষ প্রতিকৃতি চিত্রশিল্পী। তবে বাস্তবতা তাঁর শক্তি ছিল, তিনি পরাবাস্তবাদীদের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রিয় চিত্রশিল্পী ছিল সালভাদর দালি। এর পাশাপাশি তিনি আলো ছায়ার খেলা করে কিভাবে চিত্রকে ফোটানো যায় সেটাতেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি।
এই ভারতীয় চিত্রশিল্পীর কিছু বিখ্যাত শিল্পকর্ম হল –
পুতুলের সিরিজ, যা পরে দুর্গা সিরিজ নামেরও জানা যায়। তিনি এই সিরিজ চারও নকশাল আন্দোলন ও পতিতাদের নিয়েও অনেক চিত্রাঙ্কনের সিরিজ তৈরি করেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন প্রখ্যাত চিত্র এবং ভাস্কর্য শিল্পী রাম কিঙ্কর বাইজের জীবনের ওপর এক উপন্যাসের জন্য চিত্র এঁকেছিলেন। তিনি বাঙালি ঔপন্যাসিক সমরেশ বসুর ‘ দেখি নাই ফিরে ‘ – এই উপন্যাসেও চিত্ররূপ দিয়েছিলেন। তাছাড়াও তিনি নানা মনীষী যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায় প্রমুখদের প্রতিকৃতি চিত্র অঙ্কন করেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর একটি প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছিলেন যা আজও অন্যতম তাঁর সেরা প্রতিকৃতি হিসেবে ধরা হয়।
১৯৬৫ সালে প্রথম কলকাতায় প্রদর্শিত তাঁর চিত্র। তারপর থেকে বহুবার তাঁর চিত্রকার্য ভারতের সাথে সাথে বিদেশের নানা জায়গার প্রদর্শসালায় প্রদর্শিত হয়। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর চিত্রকর্মের জন্য বহু পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন । ১৯৮৮ সালে পদ্মশ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি ২০০৩ সালে ভারতের চারুকলা বিষয়ক রাষ্ট্রীয় ললিত কলা একাডেমি থেকে ললিত কলা একাডেমি ফেলোশিপ দ্বারা সম্মান অর্জন করেছিলেন। তাছাড়াও ১৯৭১ সালে জাতীয় পুরস্কার পুরস্কৃত হন। এইসব ছাড়াও ১৯৮৭ সালে বঙ্গ রত্ন, ১৯৮৯ সালে শিরোমণি পুরস্কার প্রভৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন।
এত সাফল্যের পরেও তাঁর শেষ জীবনে পারালাইটিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ায় ছবি আঁকা থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিরতি নিতে হয় এবং দীর্ঘ অসুস্থতার পর ১৯ই ডিসেম্বর ২০০৬ তিনি সকলকে বিদায় জানিয়ে পরলোক গমন করেন। তিনি আজ আমাদের মধ্যে না থাকলেও তাঁর শিল্পসৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে অম্লান ছাপ অঙ্কিত করে রেখে গেছেন চিরতরের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *