কলকাতার ভিন্টেজ গাড়ির জগতে এক অবিচ্ছেদ্য নাম — ১৯৩৭ সালের রোলস-রয়েস ২৫/৩০, যার চেসিস নম্বর GAR 71। এই গাড়িটির অতীত শুধু ঐতিহাসিক নয়, চিরস্মরণীয়ও বটে। থ্রাপ অ্যান্ড ম্যাবার্লি নির্মিত বিলাসবহুল লিমুজিন বডি, নিঃশব্দ ইঞ্জিন আর অনন্য কারুকার্যে এটি কেবল এক গাড়ি নয় — একটি জীবন্ত উত্তরাধিকার।
মূলত ইংল্যান্ডে ব্যারন হাওয়ার্ড অফ গ্লসপ-এর জন্য তৈরি হয়েছিল এই গাড়ি। পরে এটি ভারতে আসে এবং ভারত স্বাধীন হওয়ার পর কোনও এক সময় কলকাতায় রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকে বহন করেছিল বলে মনে করা হয়। আজও গাড়ির গ্লাভ বক্সে রাষ্ট্রপতির অফিসিয়াল পতাকা ও স্টাফ সংরক্ষিত আছে, যা গাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আরও গভীর করে তোলে।
১৯৫০-এর দশকে GAR 71 হয়ে ওঠে কলকাতার পরিচিত দৃশ্য। ইমপেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ এই গাড়ি অধিগ্রহণ করে এবং তাদের চেয়ারম্যানের অফিসিয়াল গাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রেজিস্ট্রেশন নম্বর WBB 1414 শিগগিরই অভিজাত মহলে পরিচিত নাম হয়ে ওঠে।
এরপর ১৯৬০-এর দশকে গাড়িটি আসে মেজর জন ফ্রান্সিস (যোগী) ক্রসলির হাতে। এই প্রাক্তন ব্রিটিশ সৈনিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘সি উলভস’ নামে পরিচিত এক গোপন দলভুক্ত ছিলেন, যারা ভারতের উপকূলে জার্মান জাহাজ ধ্বংস করতেন। ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র The Sea Wolves-এ তাদের দুঃসাহসিক কাহিনি রূপায়িত হয়, যা GAR 71-এর অতীতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
তবে সবচেয়ে দীর্ঘ ও স্নেহময় সময় এই গাড়ির কেটেছে করনানি পরিবারের সঙ্গে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাসন্ত করনানি এই গাড়ি চালিয়েছেন, সংরক্ষণ করেছেন এবং ভালোবেসেছেন। তিনি এই রোলস-রয়েসকে গ্যারাজে আটকে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে ক্লাব মিট, র্যালি কিংবা শান্ত রবিবারের ভ্রমণ — সর্বত্রই বাসন্ত করনানি ও তার রোলস-রয়েস ছিলেন একসঙ্গে।
গাড়িটি নিজেই এক শিল্পকর্ম। চালকের লেদার-কাভার্ড কেবিনের সঙ্গে যাত্রীদের জন্য ছিল ‘ওয়েস্ট অফ ইংল্যান্ড’ কাপড়ে মোড়ানো বিলাসবহুল আসন, কাঠের হ্যান্ড-ফিনিশড ড্যাশবোর্ড, মূল ইন্সট্রুমেন্টেশন ও ডানহাতে ড্রাইভের উপযুক্ত গিয়ার সিস্টেম — প্রতিটি খুঁটিনাটিতে পুরনো দিনের যত্ন স্পষ্ট।
২০২৪ সালে ক্লাসিক ড্রাইভারস ক্লাব ও ইন্ট্যাক যৌথভাবে কলকাতার ঐতিহাসিক গাড়িগুলিকে স্বীকৃতি দিতে একটি পুরস্কার চালু করে। সেখানে করনানি পরিবারের রোলস-রয়েস ২৫/৩০ ছিল ছয়টি নির্বাচিত গাড়ির অন্যতম — যা এর অতীত ও সংরক্ষণের নিখুঁততার স্বীকৃতি।
২০২৫ সালের মে মাসে বাসন্ত করনানির অকালপ্রয়াণে শহরের ক্লাসিক গাড়ি মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃদুভাষী, ভদ্র ও সর্বদা স্মৃতিচারণে আগ্রহী এই মানুষটি শুধু সংগ্রাহক ছিলেন না — ছিলেন ইতিহাসের এক রক্ষক।
এই রোলস-রয়েস ও করনানির যাত্রা শুধু গাড়ির গল্প নয়, কলকাতার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও এক নিঃশব্দ মহিমার প্রতিচ্ছবি।